বৃক্ক (Kidney) (8.2)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৫) - জীববিজ্ঞান (নতুন সংস্করণ) রেচন প্রক্রিয়া | - | NCTB BOOK
105
105

মানবদেহের উদরগহ্বরের পিছনের অংশে, মেরুদন্ডের দুদিকে বক্ষপিঞ্জরের নিচে পিঠ-সংলগ্ন অবস্থায় দুটি বৃক্ক অবস্থান করে। প্রতিটি বৃক্ক দেখতে শিমবিচির মতো এবং এর রং লালচে হয়। বৃক্কের বাইরের পার্শ্ব উত্তল এবং ভিতরের পার্শ্ব অবতল হয়। অবতল অংশের ভাঁজকে হাইলাস (Hilus) বা হাইলাম বলে। হাইলামের ভিতর থেকে ইউরেটার এবং রেনাল শিরা বের হয় এবং রেনাল ধমনি বৃক্কে প্রবেশ করে। দুটি বৃক্ক থেকে দুটি ইউরেটার বের হয়ে মুত্রাশয়ে প্রবেশ করে। ইউরেটারের ফানেল আকৃতির প্রশস্ত অংশকে রেনাল পেলভিস বলে।
বৃক্ক সম্পূর্ণরূপে এক ধরনের তক্ষুময় আবরণ দিয়ে বেন্টিত থাকে, একে রেনাল ক্যাপসুল বলে।

চিত্র ৪.02: বৃক্কের লম্বচ্ছেদ

ক্যাপসুল-সংলগ্ন অংশকে কর্টেক্স এবং ভিতরের অংশকে মেডুলা বলে। উভয় অঞ্চলই যোজক কলা এবং রক্তবাহী নালি দিয়ে গঠিত। মেডুলায় সাধারণত ৪-12টি রেনাল পিরামিড থাকে। এদের অগ্রভাগ প্রসারিত হয়ে রেনাল প্যাপিলা (Papilla) গঠন করে। এসব প্যাপিলা সরাসরি পেলভিসে উন্মুক্ত হয়।
প্রতিটি বৃক্কে বিশেষ এক ধরনের নালিকা থাকে, যাকে ইউরিনিফেরাস নালিকা বলে। প্রতিটি ইউরিনিফেরাস নালিকা নেফ্রন, (Nephron) এবং সংগ্রাহক বা সংগ্রাহী নালিকা (Collecting tubule)-এই দু'টি প্রধান অংশে বিভন্ত। নেফ্রন মূত্র তৈরি করে আর সংগ্রাহী নালিকা রেনাল পেলভিসে মুত্র বহন করে।


নেফ্রন
বৃক্কের ইউরিনিফেরাস নালিকার ক্ষরণকারী অংশ এবং কাজ করার একককে নেফ্রন বলে। মানবদেহের প্রতিটি বৃক্কে প্রায় 10-12 লক্ষ নেফ্রন থাকে। প্রতিটি নেফ্রন একটি রেনাল করপাসল (Renal corpuscle) বা মালপিজিয়ান অঙ্গ এবং রেনাল টিউব্যুল (Renal tubule) নিয়ে গঠিত।
প্রতিটি রেনাল করপাসল আবার প্লোমেরুলাস (Glomerulus) এবং বোম্যান্স ক্যাপসুল- এ দুটি অংশে বিভত্ত্ব। বোম্যান্স ক্যাপসুল গ্লোমেরুলাসকে বেষ্টন করে থাকে।
বোম্যান্স ক্যাপসুল দুই স্তরবিশিষ্ট পেয়ালার মতো প্রসারিত একটি অংশ। গ্লোমেরুলাস একগুচ্ছ কৈশিক

চিত্র ৪.০৩: একটি নেফ্রন

জালিকা দিয়ে তৈরি। রেনাল ধমনি থেকে সৃষ্ট অ্যাফারেন্ট আর্টারিওল (Afferent arteriole) ক্যাপসুলের ভিতরে ঢুকে প্রায় 50টি কৈশিকনালিকা তৈরি করে। এগুলো আবার বিভক্ত হয়ে সূক্ষ্ম রন্দ্রজালিকার সৃষ্টি করে। এসব জালিকার কৈশিকনালিগুলো মিলিত হয়ে ইফারেন্ট অ্যার্টারিওল (Efferent arteriole) সৃষ্টি করে এবং ক্যাপসুল থেকে বেরিয়ে আসে।
প্লোমেরুলাস ছাঁকনির মতো কাজ করে রক্ত থেকে পরিসুত তরল উৎপন্ন করে। এই তরলকে বলে আল্ট্রাফিলট্রেট। সেই আল্ট্রাফিলট্রেট রেনাল টিউব্যুলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় আরও কয়েক দফা শোষণ এবং নিঃসরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। সবশেষে যে তরলটি পাওয়া যায়, সেটিই মূত্র, যা সংগ্রাহী নালিকার মধ্য দিয়ে ইউরেটার হয়ে মুত্রথলিতে জমা হতে থাকে।
বোম্যান্স ক্যাপসুলে অক্ষিয়দেশ থেকে সংগ্রাহী নালি পর্যন্ত বিস্তৃত চওড়া নালিকাটিকে রেনাল টিউব্যুল বলে। প্রতিটি রেনাল টিউব্যুল ওটি অংশে বিভক্ত, গোড়াদেশীয় বা নিকটবর্তী প্যাঁচানো নালিকা (Proximal convoluted tubule), হেনলি-র লুপ (Henle's loop) এবং প্রান্তীয় প্যাঁচানো নালিকা (Distal convoluted tubule)।

একক কাজ
কাজ: মানববৃক্ক এবং নেফ্রনের চিত্র অঙ্কন করে চিহ্নিত কর।

চিত্র ৪.04 নেফ্রনের কার্যপ্রণালি

বৃক্কের কাজ
একজন স্বাভাবিক মানুষ প্রতিদিন প্রায় 1500 মিলিলিটার মূত্র ত্যাগ করে। মুত্রে ইউরিয়া, ইউরিক এসিড, অ্যামোনিয়া, ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্যপদার্থ থাকে। এগুলো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এসব অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ মুত্রের মাধ্যমে অপসারণে বৃক্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বৃক্ক বা কিডনির ভিতরের নেফ্রন একটি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে মূত্র উৎপন্ন করে। উৎপন্ন মূত্র সংগ্রাহী নালিকার মাধ্যমে বৃক্কের পেলভিসে পৌঁছায় এবং পেলভিস থেকে ইউরেটারের ফানেল আকৃতির প্রশস্ত অংশ বেয়ে ইউরেটারে প্রবেশ করে। ইউরেটার থেকে মূত্র মূত্রথলিতে আসে এবং সাময়িকভাবে জমা থাকে। মূত্র দিয়ে মুত্রথলি একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পূর্ণ হলে মূত্র ত্যাগের ইচ্ছা জাগে এবং মূত্রথলির নিচের দিকে অবস্থিত ছিদ্রপথে মূত্রনালির মাধ্যমে দেহের বাইরে বেরিয়ে আসে। এভাবে বৃক্ক বা কিডনি মানবদেহ থেকে ক্ষতিকর নাইট্রোজেন জাতীয় পদার্থসহ বিভিন্ন বর্জ্য অপসারণ করে।
বৃক্ক মানবদেহে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড ইত্যাদির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়াও মানবদেহের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, পানি, অম্ল এবং ক্ষারের ভারসাম্য রক্ষা করে।

একক কাজ
কাজ: পরের পৃষ্ঠার ছকে বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনে কোন অঙ্গ কীভাবে অংশ নেয় তা লেখ।

বর্জ্য পদার্থঅঙ্গমন্তব্য

কার্বন ডাই-অক্সাইড নাইট্রোজেনঘটিত

বর্জ্য পদার্থ ইউরিয়া, ইউরিক এসিড

অতিরিক্ত পানি

অসমোরেগুলেশনে বৃক্কের ভূমিকা
ষষ্ঠ অধ্যায়ে অভিস্রবণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বৈষম্যভেদ্য পর্দার এক পাশে যদি একটি দ্রবণ রাখা হয় এবং তার অপরপাশে থাকে শুধু ঐ দ্রবণের দ্রাবকটি (এক্ষেত্রে পানি) তাহলে বিশুদ্ধ দ্রাবকের দিক থেকে দ্রবণের মধ্যে অভিস্রবণ ঘটবে। দ্রবণের দিক থেকে চাপ প্রয়োগ করে সেই অভিস্রবণ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব। এ জন্য সর্বনিম্ন যেটুকু চাপ প্রয়োগ করতে হয় সেটিই হলো ঐ দ্রবণের জন্য অভিস্রবণ চাপ। জীবদেহে পানি এবং লবণের পরিমাণ ও ঘনত্ব এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় যাতে সামগ্রিকভাবে দেহাভান্তারে অভিস্রবণ চাপ প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। এই প্রক্রিয়াটির নাম অসমোরেগুলেশন বা পানি সাম্য।
যাবতীয় শারীরবৃত্তিক কাজ সম্পাদনের জন্য মানবদেহে পরিমিত পানি থাকা অপরিহার্য। মূলত মূত্রের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি পানি দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। দেহের পানিসাম্য নিয়ন্ত্রণে বৃক্ক প্রধান ভূমিকা পালন করে। বৃক্ক নেফ্রনের মাধমে পুনঃশোষণ প্রক্রিয়ায় দেহে পানির সমতা বজায় রাখে। গ্লোমেরুলাসে রেচন বর্জ্য, পানি এবং অন্যান্য তরল পদার্থ পরিসুত হয়। বৃক্ক অকার্যকর হয়ে গেলে দেহে পানি জমতে থাকে। চোখ-মুখসহ সারা শরীর ফুলে যেতে পারে, এমনকি উচ্চ রক্তচাপও সৃষ্টি হতে পারে। এগুলো প্রকৃতপক্ষে অসমোরেগুলেশন জনিত ত্রুটির লক্ষণ।


বৃক্কে পাথর
নানারকম রোগের কারণে বৃক্ক বা কিডনির স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন ঘটে। কিডনির প্রদাহ, প্রস্রাবে সমস্যা, কিডনিতে পাথর হওয়া এর মাঝে উল্লেখযোগ্য। কিডনির রোগের লক্ষণগুলো হলো শরীর ফুলে যাওয়া, প্রস্রাবে অতিরিক্ত প্রোটিন যাওয়া, রক্ত মিশ্রিত প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করা, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া বা ক্ষেত্রবিশেষে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া। মানুষের কিডনিতে ছোট আকারের পাথর জাতীয় পদার্থের সৃষ্টিই বৃদ্ধ বা কিডনির পাথর হিসেবে পরিচিত। কিডনিতে পাথর সবারই হতে পারে, তবে দেখা গেছে, মেয়েদের থেকে পুরুষের পাথর হওয়ার আশঙ্কা বেশি। অতিরিক্ত শারীরিক ওজন, কিডনির সংক্রমণ, কম পানি পান করা ইত্যাদি বৃক্ক বা কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণ হতে পারে।
প্রাথমিকভাবে বৃক্কে পাথর হলে তেমন সমস্যা ধরা পড়ে না। সমস্যা হয় যখন পাথর প্রস্রাব নালিতে চলে আসে এবং প্রস্রাবে বাধা দেয়। উপসর্গ হিসেবে কোমরের পিছনে ব্যথা হবে। অনেকের প্রস্রাবের সাথে রক্ত বের হয়। অনেক সময় কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। বৃক্কের পাথরের চিকিৎসা নির্ভর করে পাথরের আকার এবং অবস্থানের উপর। সাধারণত অধিক পানি গ্রহণ এবং ঔষধ সেবনে পাথর অপসারণ করা যায়। আধুনিক পদ্ধতিতে ইউরেটারোস্কোপিক কিংবা আল্ট্রাসনিক লিথট্রিপসি অথবা বৃক্কে অস্ত্রোপচার করে পাথর অপসারণ করা যায়।

Content added By
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion